ইতিহাসের প্রকারভেদ :/ইতিহাস পরিচিতি(nine-ten)
ইতিহাসের প্রকারভেদ :
মানব সমাজ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন
নতুন বিষয়ের ইতিহাস লেখা হচ্ছে। ফলে সম্প্রসারিত
হচ্ছে ইতিহাসের পরিসর। ইতিহাস বিরামহীনভাবে অতীতের
ঘটনা বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়। সেক্ষেত্রে ইতিহাসকে
বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করা কঠিন। তাছাড়া ইতিহাসের বিষয়বস্তুতে মানুষ,
মানুষের সমাজ, সভ্যতা ও জীবনধারা পরস্পর সম্পৃক্ত এবং পরিপূরক।
তারপরও পঠন-পাঠন, আলােচনা ও গবেষণাকর্মের সুবিধার্থে
ইতিহাসকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় ।
যথা- ভৌগােলিক অবস্থানগত ও বিষয়বস্তুগত ইতিহাস।
১. ভৌগােলিক অবস্থানগত দিক বা ভৌগােলিক অবস্থানগত ইতিহাস :
যে বিষয়টি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে তা কোন প্রেক্ষাপটে রচিত
স্থানীয়, জাতীয় না আন্তর্জাতিক? এভাবে ভৌগােলিক অবস্থানগত
দিক থেকে শুধু বােঝার সুবিধার্থে ইতিহাসকে আবারও
তিন ভাগে ভাগ করা যায়
যথা- স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস, জাতীয় ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস।
২. বিষয়বস্তুগত ইতিহাস:
কোনাে বিশেষ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে ইতিহাস রচিত হয়,
তাকে বিষয়বস্তুগত ইতিহাস বলা হয়।
ইতিহাসের বিষয়বস্তুর পরিসর ব্যাপক।
তবু সাধারণভাবে একে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়,
যথা- রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস,
অর্থনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ইতিহাস।
ইতিহাসের বিষয়বস্তু মানবসমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক
পরিবর্তনের প্রমাণ ও লিখিত দলিল হলাে ইতিহাস।
ঐতিহাসিক ভিকো (Vico) মনে করেন, মানব সমাজ
ও মানবীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপত্তি ও বিকাশই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যা
মানব সমাজ-সভ্যতার উন্নতি ও অগ্রগতিতে অবদান
রাখতে সক্ষম হয়েছে, তা সবই ইতিহাসভুক্ত বিষয়।
যেমন- শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন, স্থাপত্য, রাজনীতি, যুদ্ধ,
ধর্ম, আইন প্রভৃতি বিষয়, সামগ্রিকভাবে যা কিছু সমাজ-সভ্যতা
বিকাশে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে,
তা-ই ইতিহাসের বিষয়বস্তু। ইতিহাসের স্বরূপ ইতিহাস
জ্ঞান অর্জনের অন্যান্য শাখা থেকে আলাদা।
এর রচনা ও উপস্থাপনার পদ্ধতিও ভিন্ন।
ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলােচনা করলে এ সম্পর্কে
একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রথমত, সত্যনিষ্ঠ তথ্যের সাহায্যে অতীতের পুনর্গঠন
করাই ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের আলােচনার
বিষয় হচ্ছে মানবসমাজ ও সভ্যতার
অগ্রগতির ধারাবাহিক তথ্যনির্ভর বিবরণ।
তৃতীয়ত, ইতিহাস থেমে থাকে না,
এটি গতিশীল এবং বহমান। যে কারণে প্রাচীনযুগ,
মধ্যযুগ, আধুনিকযুগ সন তারিখ ব্যবহার করে
ভাগ করা কঠিন। আবার পরিবর্তনের ধারাও সব দেশে একসঙ্গে ঘটেনি।
ইতিহাস পরিচিতি
চতুর্থত, ঘটে যাওয়া ঘটনার সঠিক বিবরন
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাও ইতিহাসের বৈশিষ্ট্য।
তবে। ঘটনার নিরপেক্ষ বর্ণনা না হলে সেটা সঠিক ইতিহাস হবে না।
ইতিহাসের পরিসর মানুষ কর্তৃক সম্পাদিত সকল বিষয়
ইতিহাসের আওতাভুক্ত। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা,
কার্যক্রম যত শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত, ইতিহাসের সীমাও
ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। যেমন- প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম
পর্বের মানুষের কর্মকাণ্ড খাদ্য সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
ফলে সে সময় ইতিহাসের পরিসরও খাদ্য সংগ্রহমূলক
কর্মকাণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে
সঙ্গে ইতিহাস চর্চা ও গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
অনুসৃত হচ্ছে। ফলে ইতিহাসের শাখা-প্রশাখার সংখ্যাও
বৃদ্ধি পেয়েছে, বিস্তৃত হচ্ছে ইতিহাসের সীমানাও। উনিশ
শতকে শুধু রাজনীতি ইতিহাসের বিষয় হলেও মার্কসবাদ
প্রচারের পর অর্থনীতি, সমাজ, শিল্পকলার ইতিহাসও রচিত
হতে থাকে। এভাবে একের পর এক বিষয় ইতিহাসভুক্ত
হচ্ছে আর সম্প্রসারিত হচ্ছে ইতিহাসের পরিধি ও পরিসর।
ইতিহাস পাঠের প্রয়ােজনীয়তা মানবসমাজ ও সভ্যতার
বিবর্তনের সত্য-নির্ভর বিবরণ হচ্ছে ইতিহাস। এ কারণে
জ্ঞানচর্চার শাখা হিসেবে ইতিহাসের গুরুত্ব অসীম। ইতিহাস
পাঠ মানুষকে অতীতের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থা বুঝতে,
ভবিষ্যৎ অনুমান করতে সাহায্য করে । ইতিহাস পাঠের
ফলে মানুষের পক্ষে নিজের ও নিজদেশ সম্পর্কে
মঙ্গল-অমঙ্গলের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব ।
সুতরাং দেশ ও জাতির স্বার্থে এবং ব্যক্তি প্রয়ােজনে ইতিহাস
পাঠ অত্যন্ত জরুরি। জ্ঞান ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে :
অতীতের সত্যনিষ্ঠ বর্ণনা মানুষের জ্ঞানের পরিধি
বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। আর এ বিবরণ যদি হয় নিজ
দেশ-জাতির সফল সংগ্রাম ও গৌরবময় ঐতিহ্যের,
তাহলে তা মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। একই
সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করে।
সে ক্ষেত্রে জাতীয়তাবােধ, জাতীয় সংহতি সুদৃঢ়করণে
ইতিহাস পাঠের বিকল্প নেই। সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
ইতিহাস - জ্ঞান মানুষকে সচেতন করে তােলে।
উত্থান-পতন এবং সভ্যতার বিকাশ ও পতনের
কারণগুলাে জানতে পারলে মানুষ ভালাে-মন্দের
পার্থক্যটা সহজেই বুঝতে পারে। ফলে সে তার কর্মের পরিণতি
সম্পর্কে সচেতন থাকে।
দৃষ্টান্তের সাহায্যে শিক্ষা দেয় :
ইতিহাসের ব্যবহারিক গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষ ইতিহাস পাঠ করে অতীত ঘটনাবলির
দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারে । ইতিহাসের
শিক্ষা বর্তমানের প্রয়ােজনে কাজে লাগানাে যেতে
পারে। ইতিহাস দৃষ্টান্তের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় বলে
ইতিহাসকে বলা হয় শিক্ষণীয় দর্পন।