বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার (nine-ten)

বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার:

বাংলা ভাষা গােড়াপত্তনের যুগে স্বল্প সংখ্যক শব্দ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও নানা ভাষার সংস্পর্শে এসে এর শব্দসম্ভার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে তুর্কি আগমন ও মুসলিম শাসন পত্তনের সুযােগে ক্রমে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। এরপর এলাে ইংরেজ। ইংরেজ শাসনামলেও তাদের নিজস্ব সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করে। বাংলা ভাষা ঐ সব ভাষার শব্দগুলােকে আপন করে নিয়েছে। এভাবে বাংলা ভাষায় যে শব্দসম্ভারের সমাবেশ হয়েছে, সেগুলােকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন –

১. তৎসম শব্দ

২. তদ্ভব শব্দ

৩. অর্ধ-তৎসম শব্দ

৪. দেশি শব্দ।

৫. বিদেশি শব্দ

১. তৎসম শব্দ :

যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে সােজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ। তৎসম একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ (তৎ (তার)+ সম (সমান)]=তার সমান অর্থাৎ সংস্কৃত। উদাহরণ : চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি।

২. তদ্ভব শব্দ :

যেসব শব্দের মূল সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, সেসব শব্দকে বলা হয় তদ্ভব শব্দ। তদ্ভব একটি পারিভাষিক শব্দ। এর অর্থ, ‘তৎ’ (তার) থেকে ‘ভব' (উৎপন্ন)। যেমন – সংস্কৃত-হস্ত, প্রাকৃত-হথ, তদ্ভব-হাত। সংস্কৃত-চর্মকার, প্রাকৃত-চআর, তদ্ভব-চামার ইত্যাদি। এই তদ্ভব শব্দগুলােকে খাঁটি বাংলা শব্দও বলা হয়।

৩. অর্ধ-তৎসম শব্দ :

বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়। এগুলােকে বলে অর্ধ-তৎসম শব্দ। তৎসম মানে সংস্কৃত। আর অর্ধ তৎসম মানে আধা সংস্কৃত। উদাহরণ : জ্যোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নী, বােষ্টম, কুচ্ছিত- এ শব্দগুলাে যথাক্রমে সংস্কৃত জ্যোৎস্না, শ্রাদ্ধ, গৃহিণী, বৈষ্ণব, কুৎসিত শব্দ থেকে আগত।

৪. দেশি শব্দ :

বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীদের (যেমন : কোল, মুণ্ডা প্রভৃতি) ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাল্লায় রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দ নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না; কিন্তু কোন ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মেলে। যেমন—কুড়ি (বিশ)-কোলভাষা, পেট (উদর)–তামিল ভাষা, চুলা (উনুন)-মুণ্ডারী ভাষা। এরূপ-কুলা, গঞ্জ, চোঙ্গা, টোপর, ডাব, ডাগর, উঁকি ইত্যাদি আরও বহু দেশি শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয়।

৫. বিদেশি শব্দ :

রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে। এসব শব্দকে বলা হয় বিদেশি শব্দ। এসব বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সে কালের সমাজ জীবনের প্রয়ােজনীয় উপকরণরূপে বিদেশি শব্দ এ দেশের ভাষায় গৃহীত হয়েছে। এছাড়া পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, তুর্কি এসব ভাষারও কিছু শব্দ একইভাবে বাংলা ভাষায় এসে গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত, মায়ানমার (বার্মা), মালয়, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশেরও কিছু শব্দ আমাদের ভাষায় প্রচলিত রয়েছে।

ক. আরবি শব্দ :

বাল্লায় ব্যবহৃত আরবি শব্দগুলােকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়


(১) ধর্মসংক্রান্ত শব্দ :

আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওজু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গােসল, জান্নাত,জাহান্নাম, তওবা, তসবি, জাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল ইত্যাদি।


(২) প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ :


আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম,

কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মােক্তার,

রায় ইত্যাদি।

খ. ফারসি শব্দ :

বাংলা ভাষায় আগত ফারসি শব্দগুলােকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি।

(১) ধর্মসংক্রান্ত শব্দ :

খােদা, গুনাহ, দোজখ, নামাজ, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রােজা ইত্যাদি।

(২) প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক শব্দ :

কারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তােশক, দফতর, দরবার,

দোকান, দতখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, বেগম, মেথর, রসদ ইত্যাদি।

(৩) বিবিধ শব্দ :

আদমি, আমদানি, জানােয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাশ, রফতানি, হাঙ্গামা ইত্যাদি।

গ. ইংরেজি শব্দ :

ইংরেজি শব্দ দুই প্রকারের পাওয়া যায়।

(১) অনেকটা ইংরেজি উচ্চারণে :

ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, কলেজ, টিন, নভেল, নােট, পাউডার,

পেন্সিল, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, লাইব্রেরি, ফুল ইত্যাদি।

(২) পরিবর্তিত উচ্চারণে :

আফিম (Opium), অফিস (Office), ইস্কুল (School), বাক্স (Box),

হাসপাতাল (Hospital), বােতল (Bottle) ইত্যাদি।

ঘ. ইংরেজি ছাড়া অন্যান্য ইউরােপীয় ভাষার শব্দ

(১) পর্তুগিজ । আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি ইত্যাদি। (২) ফরাসি : কার্তুজ, কুপন, ডিপাে, রেস্তোরা ইত্যাদি।(৩) ওলন্দাজ : ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন ইত্যাদি। 

ঙ. অন্যান্য ভাষার শব্দ।

(১) গুজরাটি : খদ্দর, হরতাল ইত্যাদি।

(২) পাঞ্জাবি : চাহিদা, শিখ ইত্যাদি।

(৩) তুর্কি : চাকর, চাকু, তােপ, দারােগা ইত্যাদি।

(৪) চিনা : চা, চিনি ইত্যাদি।

(৫) মায়ানমার (বার্মিজ) : ফুঙ্গি, লুঙ্গি ইত্যাদি।

(৬) জাপানি : রিজা, হারিকিরি ইত্যাদি।

মিশ্র শব্দ :

কোনাে কোনাে সময় দেশি ও বিদেশি শব্দের মিলনে শব্দদ্বৈত সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন – রাজাবাদশা (তৎসম+ফারসি), হাট-বাজার (বাংলা+ফারসি), হেড-মৌলভি (ইংরেজি+ফারসি), হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি+তৎসম) খ্রিষ্টাব্দ (ইংরেজি+তৎসম), ডাক্তার-খানা (ইংরেজি+ফারসি), পকেটমার (ইংরেজি+বাংলা), চৌহদ্দি (ফারসি+আরবি) ইত্যাদি।

পারিভাষিক শব্দ :

বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। এর বেশিরভাগই এ কালের প্রয়ােগ।

উদাহরণ : অম্লজান-oxygen; উদ্যান-hydrogen; নথি-file; প্রশিক্ষণ-training; ব্যবস্থাপক manager; বেতার-radio; মহাব্যবস্থাপক-general manager; সচিব-secretary; স্নাতকgraduate; স্নাতকোত্তর-post graduate; সমাপ্তি-final; সাময়িকী-periodical; সমীকরণequation ইত্যাদি।

জ্ঞাতব্য :

বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার দেশি, বিদেশি, সংস্কৃত- যে ভাষা থেকেই আসুক না কেন, এখন তা বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদ। এগুলাে বাংলা ভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে, বাংলা থেকে আলাদা করে এদের কথা চিন্তা করা যায় না। যেমন—টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, রেডিও, স্যাটেলাইট ইত্যাদি প্রচলিত শব্দের কঠিনতর বাংলা পরিভাষা সৃষ্টি নিষ্প্রয়ােজন।


Next Post Previous Post
2 Comments
  • Anonymous
    Anonymous July 24, 2022 at 9:07 AM

    Best post

  • Anonymous
    Anonymous July 25, 2022 at 3:52 AM

    বাংলা ভাষা আছে বলেই তো আমরা ভালো ভাবে কথা বলতে পারি

Add Comment
comment url